
২০০০ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত আমি ইতালিতে কাটিয়েছি। ওই সময়টাতে অনেক ব্যবসা করেছি. যোগ্যতা ছিলোনা চাকরি বাকরি করার। একবার একটি ভ্রাম্যমাণ স্ট্রীট শপে কাজ করতে গেলে, মালিক পরদিন থেকে যেতে বারণ করেছিলেন।
কর্মচারী হয়ে মালিক মার্কা আচরণ ওই শপের মালিকের ভালো লাগেনি. তাই আমাকে অনেকটা মুখের উপরেই না করে দিলো।
এর পর থেকে অন্যের অধীনে কাজ করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে নিজের ভাগ্য নিজেই বানাতে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম।
কারো সহযোগিতা না পেয়ে নিজেই ভাগ্যের পেছনে দৌঁড়াতে লাগলাম ও একদিন মোটামুটি সার্থক হয়েই নিজ দেশে পাড়ি জমিয়েছি।
দেশে থাকতে পুরোদোস্তুর ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম . দেশ ছেড়েছিলাম, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এড়ানো ও নিজের ভাগ্য তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য।
তখন থাকলে হয়তো দেশের কোনো একটি জেলখানায় আমার জায়গা হতো।
যাক করুনাময়ের বদৌলতে নির্ঘাত ধ্বংশীয় জীবন থেকে বেঁচে গেছি। ইতালি থাকা কালীন কখনোই কোনো সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলামনা।
মানে হলো , ইতালিতে বসে আমাদের দেশীয় রাজনীতি থেকে দূরেই ছিলাম সব সময়। আমি সব সময় প্রবাসে বসে দেশের রাজনীতি করাটাকে ঘৃণা করেছি।
কারণ ঐসব দেশের রাজনীতি ও আমাদের দেশের রাজনীতির চিন্তা ভাবনা ও কৌশল একেবারেই ভিন্ন। এর চেয়েও বড়ো কারণ ছিলো , আমি দেশ ছেড়ে প্রবাসে গিয়েছি নিজের ভাগ্য উন্নয়ন করতে, রাজনীতি করতে নয়।
একমাত্র বাংলাদেশের মানুষ গুলি দেশীয় রাজনীতির প্রাকটিস করে থাকে প্রবাসে. আমি আর কোনো দেশের প্রবাসীদের দেখিনি নিজের দেশের রাজনীতি নিয়ে হৈচৈ ও কোনই রকম প্রাকটিস করতে।
বাংলাদেশ থেকেও ভারতীয়দের সংখ্যা অনেক বেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে , কিন্তু আমি কখনোই ভারতীয়দের এই ধরণের রাজনৈতিক মিছিল মিটিং করতে দেখিনি কোথাও।
যে সময়গুলো আমরা দেশীয় রাজনীতির জন্য আড্ডাস্থল ও বিভিন্ন পথে নষ্ট করি, সেই সময়গুলো যদি অতিরিক্ত কাজ করার জন্য ব্যয় করা হতো তাহলে আমাদের দেশের রেমিটেন্স দ্বিগুনে উন্নীত হতো।
প্রতিদিন একজন মানুষ সাধারণত প্রায় 8 ঘন্টা কাজ করে থাকে. প্রতি ঘন্টায় নূন্যতম ৭ থেকে ৮ ইউরো করে পেয়ে থাকেন।
দৈনন্দিন কাজের শেষে প্রায় প্রতিজন বাংলাদেশী রাজনীতির পেছনে ব্যয় করেন কমপক্ষে ৪ ঘন্টা।
তার মানে, প্রতি মাসে একজন প্রবাসী ১০৪ ঘন্টা নষ্ট করে থাকেন রাজনীতির পেছনে . যার মূল্য প্রতি মাসে ৮৩২ ইউরো। প্রতি বছরে যা দাঁড়ায় ৯৯৮৪ ইউরো, বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ৭৯৮৭২০ টাকা।
শুধু মাত্র ইতালিতে বাংলাদেশী আছে প্রায় ২ লক্ষ . যদি তার মধ্যে ৫০ ভাগ মানুষকে এই হিসাবের আওতায় আনি, তাহলে এই নষ্ট সময়ের বার্ষিক মূল্য দাঁড়ায় ৭৯৮৭২০০০০০০ ( সাত হাজার নয়শো সাতাশি কোটি বিশ লক্ষ টাকা)
যা দিয়ে অনায়াসে আমাদের দেশের বিশাল উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব।
যেমন , পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হচ্ছে ২৮৭৯৩৩৮ কোটি টাকা . তার মানে সৌদিআরব ও ইতালির ভিত্তিহীন ও মূল্যহীন রাজনীতির পেছনে যে সময় বাংলাদেশিরা অপচয় করে থাকে, তা দিয়ে অনায়াসে প্রতিবছর পদ্মা সেতুর মতো একটি করে মেগা প্রজেক্ট সম্পন্ন করা সম্ভব।
এবং অন্য দেশের উপর নির্ভরশীলতা সহজেই অনেক কমানো সম্ভব .
আমি বলছিনা রাজনীতি করাটা ঠিক নয়, অবস্যই রাজনীতি করতে হবে. তবে সে রাজনীতি শুধুমাত্র দেশ যখন সংকটের মুখাপেক্ষী হবে তখন।
কিন্তু আমাদের বাংলাদেশিরা সারা বছর রাজনীতি করে থাকেন, যা মোটেও ভালো কিছু বয়ে আনেনি, আনার সম্ভাবনাও নেই।
এবার আপনাদের আরেকটু পরিষ্কার করে কিছু ক্ষতির কথা তুলে ধরতে চাই , তা হলো -আমাদের দেশীয় আড্ডা বা একত্রিত হয়ে কোনো সংগঠন করার কারণে , অবস্থানশীল দেশের উন্নত কৃষ্টি কালচার থেকে দূরে সরে এসেছে আমাদের প্রবাসী সমাজ।
আমাদের নিজেদের মধ্যে থাকার প্রবণতায় অবস্থানশীল দেশের ভাষাগত সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে , কারণ সেসব দেশের স্থানীয়দের সাথে ভাষা বিনিময়ের অনুশীলন না থাকায় ব্যাকরণ সমৃদ্ধ ভাষা শেখা বা জানা সম্ভব হয়ে উঠেনা. এর ফলে অনেক সুযোগ থেকে আমরা পিছিয়ে আছি।
কৃষ্টি ও কালচার , গুরুত্ব পূর্ণ একটি বিষয়।
আমরা প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্রে গিয়ে ৩য় শ্রেণীর অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারিনি যেমন ,
রাস্তাঘাটে চলাচলে সে দেশের নিয়মকে তোয়াক্কা না করে দেশীয় স্টাইল চলনে স্থির থাকি . উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় , যেখানে সেখানে থুতু ফেলা ( পারলেতো কারো মুখের উপরে)।
ফোনে চিৎকার করে কথা বলা, অপরিষ্কার পোশাক পরে রাস্তায় বের হওয়া,
অন্যকে অসন্মান করে নিজের ইচ্ছামতো চলাফেরা করা ,পাবলিক কোড মেইন্টেন না করা।
বাসার ভিতর নিয়ম ভেঙে যা খুশি তাই করা।
আরো অনেক কিছুই আছে যা ঐসব দেশের মানুষের চোখে দৃষ্টিকটু দেখায়.
পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ও আমাদের দেশের প্রতি তাদের খারাপ ধারণা জন্মায় বৈকি!
অনেক সময় ঐসব দেশিদের মতো সমানভাবে নিজের অধিকার বুঝে নেয়ার নোংরা মানসিকতা আমাদের মাঝে জোরালো ভাবে কাজ করে , যা একেবারেই অনুচিৎ।
মনে রাখতে হবে, আমরা ঐসব দেশে অভিবাসী, অধিবাসী নই। আমাদের কিছু কিছু পদক্ষেপ ঐসব দেশের মানুষের ভিতর ভীষণ ভাবে ভীতি সঞ্চার করছে , দেশীয় স্টাইলে অভিবাসী হয়ে ওই দেশের সরকারের বিরুধ্বে আন্দোলন করা।
এই আন্দোলনকে ৯০ ভাগ ইতালিয়ান সমর্থন করেনা। এইসব আন্দোলনের কারণে তাঁদের সংসদে অভিবাসীদের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত ও ইমিগ্রেশন আইনে অনেক সুবিধাদি কমানোর সুপারিশ করছে সরকার। মনে রাখতে হবে , ইতালি ইমিগ্রান্ট কান্ট্রি নয়।
নিজের দেশের কথা চিন্তা করে দেখুন, কোনো রোহিঙ্গ্যা এসে আমার আপনার মতো অধিকার চাইলে নিশ্চই আমরা তা ভালো ভাবে নিবোনা।
বরং ঐসব দেশের প্রতি সন্মান ও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিমা আমাদের সন্মান ও অবস্থান সুদৃঢ় করবে।
তাই কথায় কথায় আন্দোলনে দাবি আদায়ের মানসিকতা , আমাদের প্রতি তাঁদের মনে ভয়ঙ্কর অবস্থান সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছু নয়।
সময়ের মূল্য দিতে পারলে নিজের উন্নতির পাশাপাশি দেশের উন্নতি ঘটবে .
সুতরাং আসুন কোনো দলাদলি বা রাজনীতি করে বিচ্ছিন্নভাবে বিভক্ত না থেকে সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে আবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে পৃথিবীতে আদর্শ ও সুন্দর মনের মানুষের দেশ হিসেবে তুলে ধরি।
সাইফুর রহমান সাগর, সাবেক প্রবাসী
লাইক দিয়ে লেখকের পরবর্তী লেখা গুলো পড়ুন
https://www.facebook.com/sagardhaka/
খবরটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে পেজে লাইক দিয়ে সাথে থাকুন